বালি ইন্দোনেশিয়ার একটা দ্বীপ আর সাউথ ইষ্ট এশিয়ার সবচে পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনের একটি। যেনে রাখা ভাল ইন্দোনেশিয়াতে ১৭,৫০০ টি দ্বীপ আছে যার মধ্যে ৮,৮০০ টার নাম আছে বাকিগুলার নাই। ৯০০ এর বেশি দ্বীপে মানুষের বসবাস নাই। জাভা আর লম্বুকের মাঝ খানে বালি অবস্থিত। বালির আর লম্বুকের মাঝে নুসা আর গিলি নামে ৬ টা ছোট দ্বীপ আছে যেগুলো খুব সুন্দর আর পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন।
সাদা বালির বিচ, পাহাড়, রাইস ট্যারেস, ভলক্যানো, পুরাতন সব মন্দির সবমিলে সহজেই পৃথিবীর বুকে স্বর্গ বলা চলে বালিকে । বালির মত ভার্সেটাইল ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন মনে হয় খুব কম ই আছে। ছোট একটা আইল্যান্ড অথচ এত দর্শনীয় স্থান কল্পনা করা যায়না। যেখানে সাউথ বালিতে রৌদ্রের তেজে গা পুড়ে যায় মাত্র ৫০-৬০ কি.মি দুরে নর্থ বালিতেই কনকনে ঠান্ডায় সোয়েটার পড়তে হয়। একদিকে যেমন সমতল আরেকদিক উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। আর ইন্দোনেশিয়া মুসলিম দেশ হলেও বালি পুরোটা হিন্দু অধ্যুষিত। সাউথ বালিতে খুব কম মুসলমান পাবেন। আর বালির হিন্দু কালচার আমাদের এখান থেকে অনেক ভিন্ন।
কখন যাবেন?
বালিতে আপনি বছরের যে কোন সময় যেতে পারেন। বালিতে দুইটা সিজন বলা চলে গ্রীষ্ম আর বর্ষা। এপ্রিল থেকে অক্টোবর হল গ্রীষ্ম বা শুকনা মৌসুম। আর নভেম্বর থেকে মার্চ বর্ষা বা ভেজা মৌসুম, এসময় বৃষ্টি হয় মূলত। বালিতে যদি ঘুরতে চান তবে ড্রাই সিজনে ঘুরতে আসা বেষ্ট হবে। এখন এপ্রিল-অক্টোবরের মধ্যে পিক ট্যুরিস্ট সিজন হল জুলাই আগস্ট। তাই ক্রাউড এভোয়েড করতে চাইলে আর অফপিক সিজনের মজা নিতে চাইলে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারীতে আসা ভাল। এই সময় আপনি সবকিছু একটু কম দামে পাবেন আর বেশি বার্গেইন করার সুযোগ পাবেন। তাছাড়া হোটেল বুকিং নিয়ে ভাবতে হবে না দিনে দিনে সব জায়গাতে হোটেল পাবেন। এছাড়া ডিসেম্বর মাস ও বাদ দেয়া উচিৎ, ক্রিসমাস আর নিউ-ইয়ারের জন্য এ সময় টা বেশ চাপ থাকে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে বালি ডিরেক্ট ফ্লাইট নেই। মালেশিয়া অথবা সিঙ্গাপুরে ট্রানজিট পড়ে। ট্রানজিট পড়ে তার মানে এই না আপনার কোন ভিসা লাগবে। ট্রানজিট এরিয়াতে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন কাজ নাই।
এয়ার টিকেট
টিকেটের দাম মাস দুই আগে কাটলে ২৮-৩৫ হাজারে পেয়ে যেতে পারেন আবার ৭ দিন আগে কাটলে সেটাই ৪০ থেকে ৫০-৫৫ হয়ে যায়। যত আগে কাটবেন তত কমে পাবেন।
বাংলাদেশ থেকে বাজেট এয়ারলাইন্স গুলোই মূলত বালি রুটে অপারেট করে যেমন মালিন্দো এয়ার , এয়ার এশিয়া, স্কুট ইত্যাদি। তবে ১০০০-১২০০ টাকা প্রব্লেম না হলে মালিন্দো এয়ার এর সার্ভিস, এয়ার ক্র্যাফট, ক্রু সব তুলনা মূলক ভালো।
ভিসা
বালিতে বাংলাদেশীদের ভিসা এক্সেমশন ৩০ দিনের জন্য অর্থাৎ কোন ভিসা লাগেনা। এখন অনেকে ভিসা অন এরাইভাল বলে, যা ভুল। এই দুটার মধ্যে পার্থক্য আছে। ভিসা এক্সেমশন হলে আপনাকে শুধু ইমিগ্রেশন লাইনে দাড়িয়ে পাসপোর্ট এরাইভাল সিল নিয়ে আপনার কাজ শেষ, কোন ভিসা ফি, ছবি বা ফর্ম পুরন করা লাগবে না। অপরদিকে ভিসা অন এরাইভালে আপনাকে ফর্ম পুরন করতে হবে,ছবি, ভিসা ফি এসব জমা দিয়ে ভিসা নিতে হবে। নেপাল বা ভুটান কখনো গেলে আরও ভাল বুঝতে পারবেন।
আপনার হোটেল বুকিং আর রিটার্ন এয়ার টিকেটের আইটিনারির প্রিন্ট কপি ইমিগ্রেশনে দেখাতে হবে। যেহেতু ভিসা এক্সেমশন তাই কোন ভিসা ফি বা ছবি কিছুই লাগেনা। আমার কাছে ইমিগ্রেশন ডলার দেখতে চাওয়া বা আর কোন কিছু দেখতে চায়নি। শুধু কতদিন থাকবো জিজ্ঞেস করে এরাইভাল সিল মেরে পাসপোর্ট হাতে দিয়ে দিল। এভাবে আপনি ৩০ দিন থাকতে পারবেন, কোনভাবেই এর মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব না।
বালিতে কোথায় ঘুরবেন আর কি কি দেখবেন?
সত্যি বলতে বালি ৭ দিনের ট্যুর না। তারপরেও অনেকে ৩-৭ দিনের ট্যুর বেশি দেয়। বালি যদি কখনো আসেন সময় করে ২ সপ্তাহ সময় নিয়ে আসবেন। শুধু বালির সব দেখতে ২ মাস লাগবে। আশেপাশের গিলি, লম্বুক এসবের কথা বাদ দিলাম। তারপরেও অনেকে সুপারম্যানের মত ৭ দিনে বালি লম্বুক গিলি নুসা পেনিদা সব ঘুরে ফেলে। সোজা উদাহরণ দিয়ে যদি বোঝাই তাহলে। বালি হল মাল্টি লেয়ারের চকলেট, আপনাকে ধৈর্য্য ধরে চুষে খেতে হবে, তাহলে প্রতিটা লেয়ারের টেস্ট বুঝতে পারবেন আর এতে সময় লাগবে। এখন আপনি একটু চুষে তারপর কামড়িয়ে যদি খান তবে একটা লেয়ারের টেস্ট পাবেন। এখন আপনি কি কি কতটা সময় নিয়ে দেখবেন আপনার উপর নির্ভর করছে। আমি নিচে বালির দর্শনীয় কিছু জায়গা সম্পর্কে ধারণা দিব সংক্ষেপে।
সাউথ বালি
শুরু টা সাউথ বালি দিয়ে করি কারণ সাউথ বালি হল সবার ট্যুরের স্টার্টিং পয়েন্ট। আর বালির ৭০% এর বেশি ট্যুরিস্ট সাউথ বালিতেই থাকে বলা যায়। তাই সাউথ বালি থেকে যত দুরে যাবেন তত কম ট্যুরিস্ট দেখবেন আর তত লোকাল মানুষ বেশি দেখবেন। পাশাপাশি বালির কালচার আর লোকাল লাইফ দেখতে পারবেন।
উরাহ্ রাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ( Ngurah Rai International Airport- DPS) : বালির একমাত্র এয়ারপোর্ট, এটা দেনপাসার শহরে পড়ে। উচ্চারণ টা কঠিন, Ng টা সাইলেন্ট থাকে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের শহর হল কুটা।
কুটাঃ কুটা বালির সবচেয়ে ডেভেলপড শহর। এয়ারপোর্ট কাছে হওয়াতে সবাই এখানে এসে উঠে। আর বালির গতানুগতিক সব ট্যুরিস্ট স্পট গুলোর মাঝখানে পড়ে। এখানে হোটেল মোটামুটি সস্তা আর এখানে থেকেই মোটামুটি সাউথ বালি পুরোটা এক্সপ্লোর করা যাবে। যারা ৩-৪ দিনের জন্য বালি ঘুরতে আসেন তাদের এখানে থাকাই বেটার হবে। আর কুটার বাইরে বালির নাইট লাইফ নাই। অন্যান্য শহরগুলো রাত ৮-৯ টার পর সব ফাঁকা হয়ে যায়, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। কুটা বালির সবচেয়ে হ্যাপেনিং প্লেস বলা যায়।
কুটা বিচঃ কুটা বিচ সার্ফিং এর জন্য বেস্ট। অনেকে এসে ৩-৪ দিনের জন্য সার্ফিং বোর্ড ভাড়া নিয়ে এখানে সার্ফিং করে। ইন্সট্রাক্টর সহ সার্ফিং করতে পারেন এখানে।
উলুয়াটু টেম্পলঃ ক্লিফের উপর বিশাল হিন্দু টেম্পল। সানসেট দেখার জন্য বেশ ভাল। চারপাশ টা বেশ সুন্দর ৩-৪ ঘণ্টা আরামে কেটে যায়। সন্ধ্যার পর এখানে বালির বিখ্যাত কেচাক ড্যান্স দেখতে পারেন। আর এখানে বানর থেকে সাবধান।
সেমিনিয়াকঃ বালির ভিলা আর লাক্সারি রিসোর্ট হোটেল গুলো এখানে। যারা হানিমুনে আসে তাদের জন্য বেস্ট। একটু এক্সপেন্সিভ ও বটে।
জিম্বারান বিচঃ সানসেট দেখার জন্য বেস্ট + সি ফুড ডিনার। তবে সি ফুড ডিনারের ব্যাপারে একটু সাবধান, দাম জিজ্ঞেস করে নিবেন আগে। অনেক কস্টলি, দেখাগেল না জেনেশুনে খেতে বসলেন বিল আসলো ৮-১০ হাজার অবশ্যই দর দাম করে নিবেন । আর যদি
নুসা দুয়াঃ ওয়াটারব্লো নামে একটা জায়গা আছে। সমুদ্রের ধারে পাহাড়ে বড় বড় ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখতে যায় সবাই। সি-ওয়াক আর ওয়াটার এক্টিভিটির জন্য ভাল।
সানুর বিচঃ এখানে সি-ওয়াক+ ওয়াটার এক্টিভিটি করতে পারেন। আর নুসা পেনিদা যেতে হলে আপনাকে এখান থেকেই ফাস্ট বোট নিতে হবে।
তানাহ লট টেম্পলঃ এটা অনেকটা বলা যায় সমুদ্রের মাঝে টেম্পল। অনেক বেশি ক্রাউডেড আর ট্যুরিস্টি প্লেস। এন্ট্রি ফি ৬০ হাজার রুপি মানে ৩৬০ টাকা। আমার তেমন পছন্দ হয়নি, আর মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। আশপাশ ঘুরে চলে আসতে হবে।
সেন্ট্রাল বালি
বালির সবচেয়ে সুন্দর পার্ট হল সেন্ট্রাল বালি। কালচার, লোকাল লাইফ, পাহাড় সব সেন্ট্রাল বালির মধ্যে।
উবুদঃ উবুদ শহর হল রিল্যাক্স করার জায়গা। এখানে হোটেল ভাড়া অনেক কম। উবুদ অনেকটা বালির মাঝখানে। তাই এখানে থেকেই আপনি পুরা সেন্ট্রাল বালি এক্সপ্লোর করতে পারবেন। বালির গ্রাম বললে ভুল হবেনা। ইয়োগা আর কুকিং ক্লাস করতে সব ইউরোপিয়ান রা এখানে থাকে। ক্রাফটের কাজ আর সুন্দর সব মন্দির এখানেই। গোয়া গাজাহ টেম্পল, তেগেনুনগান ঝর্না, গুনুং কাওয়ি টেম্পল, টেগাল্লাল্যাং রাইস ট্যারেস
উবুদ থেকে কিছুটা দুরেই জাতিলুয়িহ্ রাইস ট্যারেস। অনেকে এটাকে বালির সবচেয়ে সুন্দর রাইস ট্যারেস বলে। সময় কম থাকলে টেগাল্লাল্যাং রাইস ট্যারেস দেখলেও হয়।
বেদগুলঃ উবুদ থেকে ৫০ কি.মি মত দুরে হল বেদগুল শহর। বালির সেন্ট্রাল মাউন্টেন রেঞ্জ। একদম ঠান্ডায় কাঁপাকাঁপি অবস্থা। যদি এখানে যাবার ইচ্ছা থাকে তবে সাথে গরম কাপড় আনবেন। আমি আগে পড়াশোনা করে গিয়েছিলাম বলে সাথে গরম কাপড় নিয়েছিলাম।
বেদগুল এরিয়া তে গেলে আপনি অনেক মুসলমান পাবেন, বালিতে অনেকদিন পর বড় মসজিদ বেদগুলে দেখেছি আমি। বেদগুলে প্রথমেই যেটা পড়ে তা হল বেরাতান লেক। পাহাড়ে ঘেষা অপরুপ সুন্দর জায়গা। বেশিরভাগ সময় পাহাড়ের চুড়া মেঘে ঢেকে যায়। চোখ জুড়িয়ে যাবে দেখে। আর লেকের পাশেই বালি সবচেয়ে সুন্দর মন্দির। পুরা উলুন দানু বেরাতান টেম্পল। লেকের উপর অনেক সুন্দর সাজানো গোছানো মন্দির। আর চারপাশের আবহাওয়াতে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা আছে যা নিজে অনুভব না করলে বোঝানো সম্ভব না।
এর পরে ৫ কি.মি গেলেই বুয়্যান লেক পড়ে, এখানেও লেকের পাশে একটা টেস্পল আছে। নামটা হল পুরা উলুন দানু বুয়্যান টেম্পল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল এত সুন্দর একটা মন্দির পরিত্যক্ত! কাউকে দেখলাম না, আমি এক-ঝলক দেখে বের হয়ে এসেছি ঝটপট। ঠাণ্ডা কুয়াশচ্ছন্ন আবহাওয়া আর নির্জন মন্দির ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। গা কাটা দেবার মত অনেকটা।
এই মন্দির দেখার পর ১০ কি.মি মত গেলেই গিটগিট ওয়াটার ফল। গিটগিট আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ওয়াটারফল। এখানে পার্কিং স্পট থেকে অনেকটা পথ হেঁটে নিচে নামতে হয়। যেতে আসতে একঘণ্টা মত সময় লাগবে। ঘন্টাখানেক নিচে বসে ঝর্ণা দেখতে পারেন। তিনঘণ্টা সময় নিয়ে গেলে সবথেকে ভাল হয়।
গিটগিট ঝর্ণার ১০ কি.মি রেডিয়ামে আরও ৩ টা সুন্দর ঝর্ণা আছে। আলিং আলিং, বানয়ুমালা আর সেকুমপুল ফলস। আমার কাছে ঝর্না গুলোর চেয়ে সুন্দর মনে হয়েছে ঝর্নাগুলোতে যাবার রাস্তা। যদি সেকুমপুল যান তবে একটা পুরো দিন চলে যাবে। অনেকটা পথ ট্রেক করে যেতে হয় আর গাইড ছাড়া যেতে পারবেন না। গুগল ম্যাপ ধরে সোজা চলে যাবেন এন্ট্রি গেট থেকই গাইড নিতে পারবেন। বিভিন্ন প্যাকেজ আছে ৭০০-১৫০০ টাকা পর্যন্ত। আপনার যেটা সুবিধা হয় নিতে পারেন।
হান্দ্রা গলফ রিসোর্টঃ বালির সব জায়গাতে আপনি একধরনের গেট দেখতে পাবেন। যেটাকে বালিনিজ গেট বলে। হান্দ্রা গলফ রিসোর্টের বালিনিজ গেট টা অনেক বড় আর সুন্দর সাথে সহজেই এক্সেসিবল। আমি আগে জানতাম বালিতে সবচেয়ে সুন্দর বালিনিজ গেট এটাই পরে জানলাম এর চেয়ে অনেক সুন্দর একটা গেইট আছে, তবে সেটাতে সবাই যেতে পারবেনা। পরে কভার করছি সেটা। এই গেটের সাথে ছবি তুলতে আপনাকে সময় ভেদে লাইন দিতে হতে পারে। আর এখানে ছবি তুলতে আপনাকে ১০ মিনিট সময় দিবে তার জন্য এন্ট্রি ফি ৩০ হাজার রুপি বা ১৮০ টাকা।
মুন্দুকঃ সেন্ট্রাল বালির একটা শহর, এটা বেদগুলের পাশেই। মুন্দুক অনেকটা বাংলাদেশের বান্দরবনের মত। মুন্দুকের রাস্তায় বাইক চালানো ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। আপনি মাথা থেকে বের করতে পারবেন না এই রাস্তা। মেঘের মধ্যে দিয়ে বাইক চালাবেন রীতিমত। আর মুন্দুকে থাকতে হলে গরম কাপড় লাগবে। সেকুমপুল,আলিং আলিং, গিটগিট, মুন্দুক ফলস, এই ঝর্ণা গুলো সব দেখতে হলে আপনার মুন্দুকে থাকা বেটার হবে। আমি সময়ের অভাবে আর মুন্দুকে থাকা উবুদের থেকে কস্টলি দেখে থাকিনাই। উবুদে থেকেই যতটা সম্ভব এক্সপ্লোর করেছি। মুন্দুক যাবার পথেই ডাবল লেক ভিও পয়েন্ট পড়ে। ডাবল লেক ভিউ পয়েন্ট এ যাবার সময় রাস্তার পাশে পাহাড়েড় রাস্তা ঘেঁষে অনেক কফি শপ আছে। জমে জাওয়া ঠান্ডায় পাহাড়ের ধারে বসে কফি খাওয়ার আমেজ ই আলাদা। যদি কোলাহল থেকে দুরে প্রকৃতির মাঝে থাকতে চান তবে মুন্দুকের চেয়ে বেস্ট কিছু নেই বালিতে।
নর্থ বালি
সেন্ট্রাল বালির পরেই নর্থ বালি শুরু। নর্থ পার্ট টা বালির পুরাতন ক্যাপিটাল ছিল ডাচ দের সময়ে। লোভিনা বিচ সবচেয়ে ফেমাস জায়গা। খুব বেশি কিছু নাই এদিকে। এখানে ডলফিন দেখার এক্টিভিটি আছে একটা, যার জন্য বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট আসে। বেশকিছু ট্র্যাভেল ব্লগার এটাকে সাপোর্ট করেনা। ডলফিন দেখার এক্টিভিটি টা এতই পপুলার হয়েছে যে ডলফিনের চেয়ে নৌকা বেশি সেখানে। আর অনেকের মতে এটা ডলফিনদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আর এত ক্রাউডেড প্লেসে ডলফিন দেখে আপনি মজাও পাবেন না। আমি অনেক রিভিউ দেখে পড়াশোনা করার পর যাইনি।
ইষ্ট বালিঃ দুটা ভলক্যানো ই ইষ্ট বালিতে। মাউন্ট বাতুর আর মাউন্ট আগুং।
মাউন্ট বাতুরঃ মাউন্ট বাতুর ট্রেক বালির পপুলার একটা এক্টিভিটি। সানরাইজ দেখতে অনেকে যায় এখানে। একা একা যাওয়া যায় কিনা জানি না। আমি কুটা থেকেই ট্যুর প্যাকেজ কিনেছিলাম। ৪ লাখ রুপি মানে ২৪০০ টাকা মত। বেশি মানুষ থাকলে আরও কমে পসিবল। আমার সাথে যে ফরেনার গুলো ছিল তারা ৬-৭ লাখ রুপি মানে ৩৫০০-৪০০০ টাকা দিয়ে ট্যুর প্যাকেজ কিনেছে। তাই আপনি যত বার্গেনিং এ পটু তত বেটার ডিল পাবেন। এই খরচে আপনাকে হোটেল পিকআপ +ড্রপ, ব্রেকফাস্ট সাথে গাইড দেয়া হবে। কুটা থেকে পিক করা শুরু করে রাত ১.৩০ টা থেকে উবুদে ২-২.৩০ থেকে। তারপর সেখান থেকে ২ ঘণ্টা মত সময় লাগে যেতে।
ভোর ৪ টা সময় ট্রেক শুরু হয়, সাধারণত ৬ টা তে সানরাইজ সো তার আগেই পৌছাতে হবে। যাদের হাইটো ফোবিয়া আছে তারা ইগনোর করবেন। আর উপরে অনেক ঠাণ্ডা তাই যদি যাবার ইচ্ছা থাকে তবে গরম কাপড়, উইন্ড ব্রেকার নিয়ে নিবেন সাথে। সানরাইজ দেখার পর উপরে ব্রেকফাস্ট আর ভলক্যানো স্টিম দেখাতে নিয়ে যাবে গাইড। ফেরার সময় কিন্তামানি গ্রাম আর লুয়াক কফি প্ল্যান্টেশন ঘুরাবে। তবে আগে থেকে এগুলো কথা বলে নিবেন, যে প্যাকেজের মধ্যে এসব ঘুরাবে কিনা। নইলে সোজা টান মেরে আপনাকে হোটেলে ড্রপ করবে। আর বালিতে গোল একধরনের হ্যান্ড ব্যাগ পাওয়া যায়, সেগুলো কম দামে নিতে চাইলে কিন্তামানি তে কিনতে পারেন। সব শেষ করে হোটেল ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। সারা রাত জেগে ট্রেক করে সেদিন আর তেমন এনার্জি পাবেন না। তাই সারাদিন ঘুমিয়ে কেটে যাবে।
পুরা লেমপুয়াং লুহুর টেম্পলঃ এই টেম্পলের নাম অনেকেই জানেনা। আমি ট্যুরের একদম শেষ মুহূর্তে জেনেছিলাম, কিন্তু সময়ের কারণে হয়নি যাওয়া। এখানে একটা বালিনিজ গেইট আছে যেটাকে স্বর্গের দরজা বলে লোকাল রা। মাউন্ট লেমপুয়াং এর উপরে অবস্থিত এই টেম্পল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১৭৫ মিটার উপরে এই মন্দির। একদম নিচ থেকে মন্দিরে যেতে আপনাকে ১৭০০ মত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। প্রায় দুই ঘণ্টা সময় আর যথেষ্ট ভাল ফিটনেস দরকার। আর লোকাল দের মতে এখানে উঠার সময় যারা অভিযোগ করে যে পারবোনা বা অনেক কঠিন তারা কখনো উপরে যেতে পারেনা। এটা মাউন্ট আগুং এর বেশ কাছেই। মন্দিরের উপর থেকে মাউন্ট আগুং দেখা যায় অনেক ভালভাবে। আর যেহেতু পাহাড়ের চুড়ায় টেম্পল তাই চারপাশ দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। আর এত উঁচুতে তাই ঠাণ্ডা হবে নরমাল ব্যাপার। অনেকে এখানে সানরাইজ দেখতে আসে তাই সেটা করতে হলে আপনাকে মাউন্ট বাতুর ট্রেকের মত করে রওনা দিতে হবে। এখানে কোন প্যাকেট ট্যুর নাই, নিজে নিজেই যেতে হবে। এডভেঞ্চার পছন্দ করলে কখনোই মিস করবেন না।
ব্লু ল্যাগুন বিচ এবং বিয়াস তুগেল বিচঃ এটাও ইষ্ট বালিতে পড়ে। বালিতে আমার দেখা সবচে সুন্দর বিচ। এরকম নীল পানির বিচ নুসা পেনিদা ছাড়া পাবেন না। এই দুটা বিচ ই পাশাপাশি, সারাদিন এদিকেই কাটিয়ে দেয়া যায়। আমি উবুদ থেকে ৩৫ কি.মি মত স্কুটার চালায়ে গিয়েছিলাম। এই দুই বিচের মাঝখানে “পাদাং বাই” জেটি। পাদাং বাই থেকে মূলত গিলি আর লম্বুকের ফাস্টবোট যায়। যারা গিলি, লম্বুক যেতে চায় তাদের এখানে আসতে হবে।
ইষ্টে আমেদ আর কান্ডিডডাসা নামে দুটা গ্রাম/শহর আছে। এখানকার বিচ গুলো অনেক পপুলার শুনেছি, আমার যাওয়া হয়নি। তবে অনেকেই এদিকটায় থাকে।
নুসা পেনিদা আইল্যান্ড
বালির সবচে সুন্দর জায়গা আমার কাছে। নুসা পেনিদার মত সুন্দর বিচ বালির কোথাও পাবেন না। নুসা পেনিদাতে অনেক জায়গা আছে দেখার মত। মেইন এট্রাকশন কয়টা দেখতে চাইলে ২ দিনেই শেষ করা সম্ভব। তবে ৩-৪ দিন রিল্যাক্সে কাটালে বেস্ট হবে। নুসা পেনিদা যাবার জন্য আপনাকে প্রথমে সানুর বীচে যেতে হবে। সেখান থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ফাস্টবোট পাবেন। যাওয়া আসার টিকেটের দাম ৪ লাখ রুপি বা ২৪০০ টাকা, অর্থাৎ ওয়ান ওয়ে ২ লাখ বা ১২০০ টাকা মত পড়বে। বিচে গেলে অনেক দালাল জাপ্টে ধরবে, বেটার হয় সরাসরি ফাস্টবোটের কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কাটা। টিকেটের দাম ফিক্সড, সো দালাল ধরে টিকেট কাটবেন না। সরাসরি নিজে গিয়ে কাটবেন। সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির বেশ অনেকগুলো ফাস্টবোট নুসা পেনিদা আর বালির মাঝে যাওয়া আসা করে। তাই ডে ট্রিপ দিতে চাইলে খুব সকালে গিয়ে প্রথম বোটে করে নুসা পেনিদা গিয়ে একদম বিকালের ফাস্টবোটে ফিরে আসতে পারবেন। যাওয়া আসার সময় টা কাউন্টারে ক্লিয়ার করে কথা বলে নিবেন।
নুসা পেনিদার দুই পাশ এক্সপ্লোর করতে দুদিন সময় লাগবে। রাস্তা প্রচণ্ড খারাপ তাই দ্রুত মুভ করাও পসিবল না। ১০-১৫ কি.মি/আওয়ার এভারেজ স্পিড বলা যায়। নর্থ সাইডে আছে গিরি পুত্রি কেভ টেম্পল, সেবেলে বিচ, আতুহ বিচ আর রাজালিমা। সাউথ পার্টে আছে সেগেনিং ওয়াটারফল, কেলিংকিং বিচ, এঞ্জেলস বিলাবং, ব্রোকেন বিচ, ক্রিস্টাল বে, গামুট বে এসব।
গিরি পুত্রি টেম্পল বিশাল একটা গুহার ভিতরে, গা ছম ছমে একটা পরিবেশ, আমার বেশ ভাল লেগছিল। এরপর কিছুদূর গেলেই সেবেলে বিচ দেড় ঘণ্টা মত ভাঙা রাস্তায় ড্রাইভ করে বিচে যেতে হয়। নরমালি কেউ সেবেলে বিচ যায় না খারাপ রাস্তার কারণে। আর অনেক নির্জন জায়গা, কোন সমস্যা হলে ভাল বিপদে পড়বেন। আমি একা একা গিয়ে বেঁচে ফিরেছিলাম। তবে ভাল এডভেঞ্চেরাস জার্নি ছিল।
সেবেলে বিচ চাইলে বাদ দিতে পারেন, সেবেলে বিচের কিছুটা দুরেই আতুহ বিচ আর রাজালিমা। দুটা জায়গা পাশাপাশি মাঝখানে পাহাড় দিয়ে ভাগ করা। আতুহ বিচে অনেকে সানরাইজ দেখতে আসে। জেটি থেকে ৩৫ কি.মি রাস্তা ওয়াইল্ড এডভেঞ্চার যারা পছন্দ করে তাদের জন্য বেস্ট। আতুহ বিচ আমার কাছে বালির সবচেয়ে সুন্দর বিচ বলবো। সকালে গিয়ে সারাদিন এখানে কাটিয়ে দেয়া যায়।
এরপর দিন চলে যেতে পারেন সেগেনিং ওয়াটারফল। সেগেনিং ওয়াটারফল খুব ছোট একটা ফলস। অনেক কম মানুষ যায় সেখানে। ফলসের নিচে ন্যাচারাল বাথটাব টাইপের একটা জায়গা আছে। পাহাড়ের গা ঘেঁসে নিচে নামতে হয় ১৫ মিনিট মত। যাদের হাইটোফোবিয়া আছে তারা ভুলেও পা মাড়াবেন না ওদিকে। অনেকটা খাড়া পাহাড়ের গায়ে বাঁশ আর গাছের ডালপালা দিয়ে রাস্তা বানানো। ন্যাচারাল বাথটাবে গা ভিজিয়ে পাহাড়ের গায়ে সমুদ্রের নীল পানি আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে দিতে পারবেন। আবার উঠতে হবে ২৫ মিনিট সময় নিয়ে।
এরপর কেলিংকিং বীচ, নুসা পেনিদার সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা। অনেকে ডে ট্রিপে এখানে আসে। উপর থেকেই অনেক ভাল ভিউ পাওয়া যায়। এখানে নিচে বিচে নামতে ৪৫ মিনিট মত আর উঠতে ১ ঘণ্টা। যাদের ফিটনেস ভাল তারা আরও জলদি কমপ্লিট করতে পারবে। নীচে না নামলে অনেক কিছুই আসলে মিস করবেন। তবে সবার পক্ষে নিচে নামা সম্ভব হয়না। তবে এখানে নিচে নামলে পানিতে নামার ক্ষেত্রে খুবই সাবধান। অনেক স্ট্রং ওয়েভ, একদম টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পানিতে। তাই সাঁতার না জানলে এই বীচে পানির ধারে কাছে যাওয়া বিগ নো।
কেলিংকিং বীচ দেখা হয়ে গেলে ব্রোকেন বীচ আর এঞ্জেল’স বিলাবং যেতে পারেন। কেলিংকিং থেকে কিছুটা দুরেই এই জায়গাটা পড়ে। এঞ্জেল’স বিলাবং এ পাহাড়ের খাদে জমে থাকা সমুদ্রের নীল পানি আর ব্রোকেন বিচ গোল একটা বিশাল খাদের মাঝে সুন্দর বীচ। ব্রোকেন বীচে নিচে নামার পথ দেখিনাই। তবে এঞ্জেল’স বিলাবং এ নোনা পানিতে গোসল করতে পারবেন।
নুসা পেনিদাতে অনেকে ডে ট্রিপ দেয়। ডে ট্রিপে সাধারণত সাউথ পার্ট টা দেখে। কেলিংকিং বিচ, এঞ্জেল’স বিলাবং, ব্রোকেন বীচ, ক্রিস্টাল বে এসব দেখে চলে যায়। ডে ট্রিপ কোন ট্যুর কোম্পানি থেকে না কিনে নিজে নিজেও সানুর গিয়ে টিকেট কেটে ঘুরে আসতে পারবেন।
নুসা পেনিদার সাথে আরও দুটা ছোট ছোট আইল্যান্ড আছে, নুসা ল্যাম্বোনগ্যান আর নুসা সেনিগ্যান। সময় থাকলে এ দুটোও ঘুরে আসতে পারেন। নুসা পেনিদা থেকে বোটে করে গিয়ে, এ দুটো আইল্যান্ড একদিনেই ঘুরে শেষ করতে পারবেন।
বালিতে আরও অনেক কিছু দেখার আছে, আমার পক্ষে সব দেখা সম্ভব হয়নি। তাই ঘুরতে যাবার আগে ডু ইয়োর ওন রিসার্চ। আপনার পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র, পুরাতন স্থাপত্য না আর্টিফিশিয়াল এমিউজমেন্ট পছন্দ তার উপর নির্ভর করে ট্যুর প্ল্যান করবেন। তাহলে কম সময় নিয়ে গেলেও উপভোগ করে আসতে পারবেন।
যেখানেই ঘুরতে যান ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। শুধুমাত্র নিজের পায়ের ছাপ ফেলে আসবেন।